পৃথিবীর সবাই স্বপ্ন দেখে কিন্তু সেই স্বপ্ন বাস্তবে রুপান্তর করার সাহস ও মেধা খুব কম মানুষেরই থাকে। ইলন মাস্ক সেই ক্ষণজন্মা সাহসী মানুষদের মধ্যে একজন। তিনি তার মেধা, সাহস ও বুদ্ধি কে কাজে লাগিয়ে পেপাল, স্পেস এক্স ও টেসলার মতো কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন। 

ইলন মাস্ক কে বলা হয়ে থাকে বাস্তব জীবনের একজন আয়রনম্যান। তিনি স্বপ্ন দেখেছেন পৃথিবীর বাইরেও মানুষের অস্তিত্ব কে ছড়িয়ে দেয়ার। তিনি পুনরায় ব্যবহারযোগ্য রকেট তৈরি করেছেন। তার এই আবিষ্কার মহাকাশ ভ্রমণ টেকনোলজি কে এগিয়ে নিয়ে গেছে আরও ১০০ বছর সামনে।  

মাত্র ২০ বছর আগেও ইলন মাস্ক নামটি খুব একটা শোনা যায়নি। কিন্তু আজ মাত্র কুড়ি বছরের ব্যবধানে তিনি এতো সফলতা পেয়েছেন যে কারণে ইলন মাস্ক কে পৃথিবীর সবথেকে বড় সফল ব্যাক্তি বলা হয়। এবং তিনি বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ধনী ব্যাক্তি।  

আর আজকে আমরা উন্মোচন করবো ইলন মাস্কের শৈশব থেকে আজ অব্ধি তার উত্থান, পতন ও তার সফলতার গল্প এবং রহস্য উন্মোচন করবো। কিভাবে তিনি টেসলা, পেপাল, স্পেস এক্স, ব্রেইন চিপ সহ ইত্যাদি নিয়ে কাজ করে একজন সফল উদ্যোগতা ও পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ধনী ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন। 


ইলন মাস্কের পরিচয় ও ছোটবেলা 

ইলন মাস্ক ১৯৭১ সালের ২৮ জুন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়া শহড়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার মা ছিলেন একজন মডেল ও ডায়েটিশিয়ান এবং ইলন মাস্ক এর বাবা ছিলেন একজন মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার। 

ছোটবেলা থেকে ইলন মাস্ক বই পড়তে ভিষন ভালবাসতেন। বলা যায় তিনি বইপোকা ছিলেন। জানা গেছে ছোটবেলায় তিনি প্রায় ১০ ঘন্টা বই পড়তেন। একটি ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে ইলন মাস্ক বলেন আমি মানুষ হয়েছি বই পড়ে।

ছোট বেলা থেকেই তার সাহস, মেধা ও চিন্তাধারা ছিল একেবারেই আলাদা। তিনি ছোটবেলা থেকেই এমন সব ব্যাবসার আইডিয়া খুজে বের করতেন। যা আমাদের কল্পনার বাইরে। তিনি সবসময় সৃজনশীল কিছু চিন্তা করতেন। আর এসব দিক দিয়ে ইলন মাস্ক সবসময় সফল ছিলেন। 


ইলন মাস্ক এর সফলতার গল্প 

ইলন মাস্ক ১০ বছর বয়স থেকেই কম্পিউটার কে প্রচন্ড ভালবাসতে শুরু করেন। তিনি কম্পিউটার কে এতো ভালবাসতেন যে মাত্র ১২ বছরের মধ্যেই তিনি কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শিখে ফেলেন। এ সময় তিনি একটি বাস্টার নামক গেমস ও তৈরি করে ফেলেন। পরবর্তীতে তিনি বাস্টার নামক গেমস টি $৫০০ ডলারের বিনিময়ে একটি ম্যাগাজিনের কাছে বিক্রি করেন।

তারপর তিনি পড়াশোনার জন্য আমেরিকাতে চলে আসেন। তিনি আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব পেন্সিলভেনিয়া থেকে পদার্থ বিজ্ঞান ও অর্থনীতি বিষয়ে তার পড়াশোনা শেষ করেন। এর পরই তার জীবনের সবথেকে বড় ধাক্কাটি খেয়ে বসেন।  তিনি গিয়েছিলেন নেটসকেপ নামক একটি কোম্পানিতে চাকুরির জন্য।  কিন্তু  কম্পিউটার ডিগ্রি না থাকার কারণে তাকে চাকুরী দিতে পারেনি কোম্পানিটি। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস আজ সেই ব্যক্তি পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি এবং একজন সফল উদ্যোগতা।

নেটসকেপের সেই রিজেকশন দমিয়ে রাখতে পারেনি ইলন মাস্ক কে। রিজেকশনের পর ইলন মাস্ক তার ভাই কিম্বল এর সাথে জিপ-টু (ZIP2) নামে একটি ওয়েব এপ্লিকেশন প্রতিষ্ঠা করেন। জিপ টু সংবাদ পত্রের জন্য একটি ট্রাভেল গাইড হিসেবে কাজ করতো। 

জিপ টু যখন আস্তে আস্তে সফল হতে থাকে তখন সেই কোম্পানির বোর্ড অফ ডিরেক্টররা মাস্কের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন।  তারপর বোর্ড অফ ডিরেক্টর সিদ্ধান্ত নিয়ে মাস্ক কে সিইও (CEO) পদ থেকে বহিষ্কার করেন। পরবর্তীতে জিপ টু ৩০৭ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে কম্প্যাক কম্পিটার্স  এর কাছে বিক্রি হয়ে যায়। সেখান থেকে ইলন মাস্ক তার শেয়ারের ২২ মিলিয়ন ডলায় পান।


এই শেয়ার থেকে পাওয়া অর্থ আপনি বা আমি পেলে হয়তো বিলাসবহুল জীবন কাটানোর চিন্তা করতাম। কিন্তু ইলন মাস্ক এই টাকার অর্ধেকের থেকেও বেশি টাকা বিনিয়োগ করেন এক্স ডটকম নামের একটি অনলাইন ব্যাংকিং সিস্টেম চালু করতে। এই কোম্পানি থেকেই পরবর্তীতে চালু হয় পৃথিবীর সবথেকে বড় অনলাইন ব্যাংকিং সিস্টেম পেপাল। প্রাথমিক অবস্থায় পেপাল এর সিইও (CEO) ছিলেন ইলন মাস্ক। কিন্তু এরপর তাকে পদ হারাতে হয়।  ২০০২ সালে Ebey পেপাল কে কিনে নেয় এবং ইলন মাস্ক ১৮০ মিলিয়ন ডলার পেয়ে যায়।

২০০১ সালে ইলন মাস্ক মঙ্গল গ্রহে একটি এক্সপেরিমেন্টাল গ্রীনহাউজ তৈরির আইডিয়া প্রকাশ করেছিলেন। পেপাল থেকে পদ হারানোর পর মাস্ক রাশিয়া চলে গিয়েছিলেন পুরনো ইন্টারকন্টিনেন্টাল মিসাইল কেনার জন্য। ইলন মাস্কের উদ্দেশ্য ছিল তিনি রকেটের মাধ্যমে মঙ্গল গ্রহে একদল ইদুল পাঠাবেন। রাশিয়ানরা তখন মাস্কের প্রস্তাবে রাজি হয় এবং প্রতিটি রকেটের জন্য দাবী করে ৮ মিলিয়ন ডলার।

ইলন মাস্কের কাছে ৮ মিলিয়ন ডলার অনেক বেশি মনে হয়। তখন ইলন মাস্ক বলেন আমরা আমাদের রকেট নিজেরাই তৈরি করবো। একথা শুনে রাশিয়ানরা মাস্ক কে নিয়া হাসিঠাট্টা করেছিলেন। ফেরার পথে ফ্লাইটে বসেই মাস্ক চিন্তা করেন যে তিনি নিজেই একটি রকেট তৈরির কোম্পানি চালু করতে পারেন। যেটা কম মূল্যেই তার জন্য রকেট তৈরি করতে সক্ষম হবে। মাস্ক চিন্তা করে দেখেন যে, রকেট তৈরির কাঁচামালের মূল্য রকেট মূল্যের ৩%। সেখান থেকেই তিনি একটি বহিপ্লবিক আইডিয়া নিয়ে কাজ শুরু করেন। 

২০০২ সালের তিনি মাত্র ১০০ মিলিয়ন ডলার নিয়ে মাস্ক স্পেস এক্স চালু করেন। মাস্কের উদ্দেশ্য ছিল বিশাল।  তিনি চেয়েছিলেন বানিজ্যিক ভাবে স্প্রেসশিপ তৈরি করতে যা স্পেস ট্রাভেলের খরচ অনেকটা কমিয়ে নিয়ে আসবে। 

এরপর ২০০৬ সালে স্পেস এক্স (Space X) তাদের প্রথম রকেট ফ্যালকন মহাকাশে লঞ্চ করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো রকেটটি লঞ্চ করার মাত্র ৩৩ সেকেন্ড পরই রকেট টি বিষ্ফোরিত হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। আরও একবার ব্যার্থ হন ইলন মাস্ক।

কিন্তু ব্যার্থতা যেন কোনভাবেই দমিয়ে রাখতে পারে না মাস্ক কে। পরবর্তীতে তিনি আবার রকেট তৈরি করে মহাআকাশের পথে পাড়ি জমাতে চাইলে আবারও ব্যার্থ হন। এভাবে পরপর তিনবার ব্যার্থ হয় স্পেস  তার ৩য় বারের ব্যার্থতা স্পেস এক্স কে প্রায় ধ্বংশের পথে নিয়ে আসে। পরপর তিনবার ব্যার্থ হওয়ার পর ধৈর্য হারিয়ে ফেলেনি। অন্য কেউ হলে হয়তো দমে যেতো। কিন্তু আমরা কথা বলছি বাস্তব জীবনের আয়রন ম্যান ইলন মাস্ক কে নিয়ে।  


তখন ইলন মাস্কের কাছে শুধু চার নাম্বার রকেট উরানোর মতোই টাকা ছিল। তখন তিনি তার সবকিছু বাজি রেখে ২০০৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর চতুর্থ ফ্যালকন রকেট লঞ্চ করেন। এবং তা সফলভাবে পৃথিবী ছেড়ে মহাআকাশে চলে যায়। এভাবেই মাস্ক ইতিহাস তৈরি করেন। তার লঞ্চ করা ফ্যালকন-১ পৃথিবীর প্রথম ব্যাক্তিগত রকেট যা সফলভাবে পৃথিবীর কক্ষপথে ঘুরতে সক্ষম হয়েছে।

২০০৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর নাসা স্পেস এক্স কে ১.৬ বিলিয়ন ডলারের কন্ট্রাক্ট দেয়। তাদের কাজ ছিল মহাআকাশ স্পেস স্টেশনে মালবাহী কার্গো ট্রান্সপোর্ট করা। এরপর স্পেস এক্স বারবার ব্যবহার করা যায় এমন রকেট সম্পর্কে গবেষণা করা শুরু করে। এবং বেশ কিছু ব্যার্থতার পর ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে স্পেস এক্স সফলভাবে তাদের রকেট ল্যান্ড ও রিকভার করতে সক্ষম হয়। 

এরপর স্পেস এক্স ২০১৭ সালে আবার একটি রকেট লঞ্চ করে এবং সমুদ্রের উপর ল্যান্ডিং করায়। এটা ছিল একটি পারফেক্ট ল্যান্ডিং। একটা স্বপ্নের পারফেক্ট বাস্তবায়ন। স্পেস এক্স একমাত্র কোম্পানি যাদের রকেট ধ্বংস হওয়া ছাড়াই ল্যান্ড করতে পারে আবার সফলভাবে সেটা আবার ব্যবহার ও করা যায়। ইলন মাস্ক বলেন যে তার এই রিইউজেবল রকেট আরও কার্যকর হলে মহাআকাশ ভ্রমনের খরচ আরও অনেকখানি কমে যাবে।

ইলন মাস্ক স্বপ্ন দেখেন যে রেড প্ল্যানেট এ শহড় বানাবেন আর সেখানে তৈরি হবে মানুষের কলনি। এছারা মাস্ক পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় গাড়ি টেসলা মটর এর কর্ণধর। তিনি ২০০৩ সালে টেসলা মটর প্রতিষ্ঠা করেন। টেসলা মটর নিয়েও ইলন মাস্ক অনেকবার ব্যার্থ হয়েছিলেন এবং তারপর সফল ও হয়েছেন। টেসলা মটর এর প্রথম বানানো ও সফল ইলেক্ট্রিক গাড়ির নাম Roadstar. অনেকবার ব্যার্থ হবার পর টেসলা কোম্পানি সফল হয়েছে। বারবার তার কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার মুখে পড়েছিল কিন্তু ইলন মাস্ক হাল ছাড়েনি। তিনি স্বপ্ন দেখিয়েছেন এবং তার বাস্তব রুপ ও দেখিয়েছেন। 

বর্তমানে ইলন মাস্ক কাজ করছেন নিউরালিঙ্ক নিয়ে। যা মানুষের ব্রেইন চিপ হিসেবে কাজ করবে। ইন্টারনেটে এই চিপ নিয়ে অনেক তথ্য ছড়িয়েছে। 

ইলন মাস্ক পৃর্থিবীকে একটি বাসযোগ্য ও সুন্দর একটি পরিবেশ উপহার দেয়ার চেষ্ঠা করে যাচ্ছেন। পৃর্থিবীতে  এমন কিছু মানুষ আছে যারা জন্মই হন সকল গুনাবলি নিয়ে। যারা সকল বাধা বৈরিতা পেরিয়ে সফলতার দিকে এগিয়ে যায়। যার বাস্তব উদাহরণ হলো ইলন মাস্ক। চেষ্ঠা, নিজের প্রতি বিশ্বাস আর ধৈর্য ইলন মাস্ক কে এগিয়ে নিয়ে গেছে উন্নতির চরম শিখায়। যা আজ তাকে বানিয়েছে পৃর্থিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি।